পরিবারের মেয়ে শিশুদের কাছে বাবা মানে মূর্তিমান আতংক।

নব্বই দশকের এক প্যারেন্টসকে চিনতাম। বাবা যে রুমে ঘুমাতেন সেটা ছিলো পুরো ঘরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম কর্ণার। বাবার খাটে জাজিম, তোষক, পরিষ্কার বিছানার চাদর। এছাড়া রুমের অনন্যা আসবাবপত্রও বেশ উত্তম। সে ঘরের টিভিটা বাবার রুমে। বাক্সে বন্ধি টিভির চাবি থাকত বাবার নিয়ন্ত্রণে।


আর তাদের ছেলে-মেয়ে যে রুমে ঘুমাতো, সেখানে তো খাট নেই-ই বরং চার কোণা ছোট্ট একটা চৌকি। সে চৌকিতে ফাটা, ছেঁড়া একটা শীতল পাটি। যেখানে প্রশ্রাবের গন্ধে উঁকি দেয়া যায় না।


সে পরিবারের মেয়ে শিশুদের কাছে বাবা মানে মূর্তিমান আতংক। কোনোদিন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি। কোনো আবদার, আরজি করার তো প্রশ্নই আসে না। তাদের যত দাবী বা প্রার্থনা সব মা পর্যন্তই সীমাবন্ধ।


খাবার ক্ষেত্রে মাছের বড়ো টুকরো, মাথা সব বাবার দখলে। তিনি বসে খেতেন টেবিলে। আর বাচ্চারা নিচে মাদুর বিছিয়ে লেজ বা লেজের পাশের কাঁটাযুক্ত টুকরো দিয়ে কোনোমতে খেয়ে উঠে যেত।


আজ সে ধরনের এক বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেছি। শেষ বয়সে উনার স্থান হয়েছে ঘরের বাহিরে ছোট্ট একটা খুপরি ঘরে। যেখানে তিনি প্রশ্রাব, পায়খানায় ডুবে থাকতেন দিনের পর দিন। মাছি, মশা ছাড়া কেউ উঁকি দিতো না। খাবার সময় কেউ নাক চেপে টিনের একটা থালায় ভাত আর ডাল দিয়ে আসত। অথচ তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সবাই কর্মক্ষম এবং জীবিত ছিল। মৃত্যু সংবাদ শুনে কেউ কাঁদেনি।

এসব হচ্ছে রিভেঞ্জ অব নেচার।

ঐ সমসাময়িক আমার আব্বা ছিলেন একজন আদর্শ বাবা। তিনি ঘরের জন্য নতুন মশারি কিনলে আমাদের পুরনো মশারি নিজের রুমে নিয়ে নতুন মশারি আমাদের রুমে দিতেন। একটা লেপ কিনলে আমাদের রুমের ব্যবহৃত লেপ নিয়ে নতুন লেপ আমাদের রুমে দিতেন।


খাবার সময় আমাদেরকে পাশে নিয়ে বসতেন। মাছের বড়ো টুকরো, পেটি, মাথা সব আমাদেরকে খাইয়ে নিজে কাটা চুষে খেতেন। আমাদের জন্য ঈদের সময় নতুন পোশাক কিনতে সব বাজেট শেষ করে নিজে আগে কেনা পাঞ্চাবি পরে ঈদ করতেন। মানে আমরা ছিলাম আমার বাবার কাছে পুতুলের মতো। যিনি রাতে আমাদের মশারি লাগিয়ে দিতেন, আমাদের রুমের জানালা নিজ হাতে বন্ধ করে দিতেন।


এবার ঈদে আমার ভাইকে বলি,


"ঈদের সময় আব্বার জন্য কী কিনেছিস?"


" আপা, আব্বার বাজেট পনেরো হাজার টাকা। এখন উনার আঠারো হাজার অলরেডি শেষ। এখনো টুপি কিনিনি। আব্বার জুতাই নিয়েছে ৫,২০০ টাকা।"


আমার ভাইয়ের বউকে জিজ্ঞেস করি,


" আব্বা ভাত খাইছে?


" না আপু। আব্বা পরে খাবেন। আমি আব্বার জন্য মুরগির রানের টুকরো, বুকের টুকরো আলাদাভাবে তুলে রেখেছি।"


আমার ভাই, ভাইয়ের বউ সবসময় চেষ্টা করে আব্বার জন্য উত্তম পোশাক, উত্তম খাবার, উত্তম জীবন ব্যবস্থা দিতে।


ভাই বাবা-মায়ের সন্তান। ভাইয়ের বউ নয়। অথচ আব্বা আম্মার প্রতি তার নজর সবচেয়ে বেশি।


এসবই হয়তো রিভেঞ্জ অব নেচার।


সেইম ঘটনা একজন শাশুড়ির জীবনেও ঘটবে। আপনি যা করবেন, তাই ফিরে পাবেন।

প্রকৃতি কখনো তার লালিত সন্তানকে বঞ্চিত করে না।


লেখক: 

কামরুন নাহার মিশু

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url