দুবাইয়ের দশ বছরের জীবন!

কুমিল্লার মুরাদনগর এলাকার রফিক দশ বছর আগে দুবাই পাড়ি জমিয়েছিল এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। বাবা-মায়ের হাতে নিজের জন্য আর কিছু না হোক, ভাই-বোনদের জন্য অন্তত একটা স্থায়ী আয়ের উৎস গড়ে তোলার ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তার ছোট ভাই শফিক, যে গ্রামে কোনো কাজ পাচ্ছিল না, তাকেই ভরসা করে রফিক শুরু করল দিনের পর দিন মরুভূমির কারখানায় শ্রমিকের কাজ।

​তার মাসিক বেতনের প্রায় পুরোটাই আসত দেশে। উদ্দেশ্য: পৈতৃক ভিটার পাশে একটা বড় আকারের পোল্ট্রি ফার্ম দেওয়া। শফিককে সে বলেছিল, "শফিক, ব্যবসাটা তো আমাদের দুজনের। তুই দেখভাল কর, আমি টাকা পাঠাই। আমি ফিরে এলে আমরা দুজন মিলেই চালাব। তোকে আলাদা করে বেতনও নিতে হবে না, লাভের অর্ধেক তো তোরই।"


​তৈরি হলো ‘ভাই-ভাই পোল্ট্রি’

​রফিকের কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে ‘ভাই-ভাই পোল্ট্রি’ ফার্মটি এলাকার অন্যতম বৃহৎ ফার্মে পরিণত হলো। দিনের বেলায় ১২ ঘণ্টা কারখানায় কাজ করার পর রাতের বেলা রফিক ওভারটাইম করত শুধু আরও দ্রুত টাকা জমানোর জন্য। দশ বছরে সে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা দেশে পাঠিয়েছে।


​শফিক প্রতি মাসেই ভিডিও কল করে ফার্মের অগ্রগতি দেখাত। রফিক দেখত তার ছোট ভাই কত যত্ন করে ব্যবসা সামলাচ্ছে। গ্রামের মানুষও শফিকের প্রশংসা করত, বলত—রফিকের মতো বড় ভাই যার আছে, তার আর কীসের চিন্তা! রফিকের বুক গর্বে ভরে উঠত।


​ঘরে ফেরা এবং অচেনা ভাই;


​দশ বছর পর, রফিক একদিন আচমকা দেশে ফেরার টিকিট কেটে ফেলল। সে আর কারও সাথে যোগাযোগ করেনি, শফিককে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। তার স্বপ্ন ছিল, এবার সে ফিরে এসে শফিকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসাটা দেখভাল করবে, এবং অবশেষে বিয়ে করে একটা স্বাভাবিক জীবন শুরু করবে।


​এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গ্রামে ফিরেই যখন সে ফার্মের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, শফিক তখন কর্মচারীদের সাথে কী নিয়ে যেন ব্যস্ত। রফিককে দেখে শফিক প্রথমে থমকে গেল, তার চোখে আনন্দের চেয়েও বেশি কিছু একটা লুকানো ছিল - ভয়? না, অস্বস্তি?


​রফিক হাসিমুখে বলল, "কিরে শফিক! সারপ্রাইজ! এবার আমি চলে এসেছি, দু'জন মিলে কাজ করব।"

​শফিক স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কথা জড়িয়ে গেল, "দাদা, ভালো করেছিস। তবে... তুই কি পাকাপাকিভাবে ফিরে এসেছিস?"


​আইনের বেড়াজাল;


​পরের দিন সকালে, যখন রফিক হিসাবপত্র দেখতে চাইল এবং ব্যবসা পরিচালনার কিছু দায়িত্ব নিতে চাইল, তখন শফিক তাকে ফার্মের ভেতরের অফিসে নিয়ে গেল। টেবিলের ওপর একগাদা কাগজ, যার ভাঁজে ভাঁজে ছিল আইনজীবীর সিল ও স্বাক্ষর।


​শফিক অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল, "দাদা, ব্যবসা এখন পুরোটাই আমার নামে। তোর টাকাটা ছিল আসলে ‘ঋণ’। আর এতদিন তুই আমাকে যে টাকা পাঠিয়েছিস, সেটার বিনিময়ে আমি তোকে ‘ব্যবস্থাপনা ফি’ হিসেবে প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতাম।"


​রফিক হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, "মানে কী? আমি তোর জন্য, পরিবারের জন্য ৬৫ লাখ টাকা দিলাম, আর তুই বলছিস ঋণ? ‘ভাই-ভাই পোল্ট্রি’ তোর একার নামে কীভাবে হলো?"


​বাবা-মাকে ডাকতেই শফিক এবার তার আসল রূপ দেখাল। সে বলল, "প্রথম পাঁচ বছর ফার্মে লোকসান চলছিল, সেটা তোর জানা দরকার ছিল না বলে আমি বলিনি। আমি নিজের চেষ্টায় ধারদেনা করে ব্যবসাটাকে দাঁড় করিয়েছি। আর আম্মা-আব্বাকে আমিই তো দেখি! তুই তো বিদেশে ছিলি!"

​বাবা-মা সেখানে নিরব দর্শক। তারা ভয় পাচ্ছিল শফিককে রাগাতে, কারণ এখন শফিকই তাদের একমাত্র ভরসা। আম্মা শুধু বললেন, "বাবা রফিক, শফিক তো তোর ছোট। এতদিনের পরিশ্রমের ফলটা যদি ও একাই পায়, তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?"


​রফিক বুঝতে পারল, তার নিজের পরিশ্রমের ফলকে ভাই আর বাবা-মা মিলে ‘ভাই-ভাই’ থেকে ‘শফিকের ব্যবসা’ বানিয়ে দিয়েছে। তার কাছে যা ছিল ভাইয়ের প্রতি বিশ্বাস, তাদের কাছে তা ছিল একটি সুযোগ।


​সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে, সেই ৬৫ লাখ টাকার মালিকানা আর ভাইকে হারানোর কষ্ট নিয়ে রফিক গ্রামে আর টিকতে পারল না। এক সপ্তাহের মধ্যে সে আবার দুবাইয়ের ফ্লাইট ধরল। শফিককে সে শুধু বলে গেল, "একদিন দেখবি, এই বিশ্বাসের দাম তোকে দিতে হবে।"


​ঠিক দু'বছর পর, অতিরিক্ত লোনের কারণে শফিকের সেই পোল্ট্রি ফার্মটি নিলামে উঠল। কিন্তু ততদিনে রফিকের জীবনে ক্ষতটা এতটাই গভীর হয়েছে যে, সে আর ফিরে এসে পুরোনো ভিটে বা ভাই-বোনের খোঁজও রাখেনি। পরিবারের প্রতি তার ভালোবাসার সেই আগুন চিরতরে নিভে গেছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url